নিউজ ডেস্ক // বাংলাদেশে বসবাসকারী বিভিন্ন উপজাতি বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোকে অনেকেই আদিবাসী বলতে চায়।
কেউ জেনেশুনেও বলে, একটা সুদূর পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আবার কেউ না জেনে ও না বুঝেই বলে।
এবিষয়ে সবারই চোখ কান খোলা রাখা ও সতর্ক থাকা উচিত।
ঐতিহাসিক তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে দেখা যাক- আসলে তারা কী?
বাংলাদেশে প্রধান ৩৩টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী রয়েছে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর অধিকাংশ পার্বত্য চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, সিলেট, রাজশাহী ও রংপুর অঞ্চলে বসবাস করে। এছাড়াও কিছু অংশ দক্ষিণে সাগর তীরবর্তী অঞ্চল- কক্সবাজার, পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলায় বাস করে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ ২০২২ সালের জন শুমারিতে এদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সংখ্যা ৫০টি দেখানো হলেও এদের মধ্যে কিছু পেশাগত শ্রেণি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে- যারা প্রকৃত অর্থে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর আওতায় পড়ে না। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বা ভিন্ন জাতিসত্তা তাদেরই বলা হয়, যারা কোনো ভূখণ্ডের মূল জনগোষ্ঠীর মধ্যে বসবাস করেও নিজস্ব সামাজিক রীতিনীতি ও ধর্মীয় আচার এবং পৃথক গোত্রপ্রথা ও পরিবারব্যবস্থা অনুসরণ করে থাকে। তাদের রয়েছে স্বতন্ত্র খাদ্যাভ্যাস, ভাষা, সংস্কৃতি ও ধর্মবিশ্বাস। বাংলাদেশের অধিকাংশ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বৌদ্ধ, হিন্দু ও খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী হলেও একই সাথে তারা প্রকৃতি পূজারি। অনেক নৃগোষ্ঠীর নিজস্ব গোত্রপ্রধান রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে পৃথক প্রথাগত প্রশাসনিক ব্যবস্থা বিদ্যমান। এই অঞ্চলের চাকমা, বোমাং ও মং সার্কেলের প্রধানকে চীফ বা রাজা বলা হয়।
নৃতাত্ত্বিক দিক থেকে বাংলাদেশে বসবাসকারী সকল ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অধিকাংশই মঙ্গোলয়েড ও অস্ট্রালয়েড জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত।
সর্বশেষ শুমারি অনুযায়ী, বর্তমানে এদেশে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর মোট সংখ্যা প্রায় সাড়ে ১৬ লক্ষ। অর্থাৎ দেশের মোট জনগোষ্ঠীর শতকরা এক ভাগ মাত্র। জনসংখ্যার দিক থেকে এদের মধ্যে চাকমা নৃগোষ্ঠীর সংখ্যা সর্বাধিক। এর পরেই রয়েছে মারমা, ত্রিপুরা, সাঁওতাল, ওরাঁও ও গারো।
উপজাতি (tribe) এবং আদিবাসী (Aboriginal /Indigenous) পরিভাষা দুটি নিয়ে বিতর্ক বা সংশয় রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে লেখক-গবেষকদের নিবন্ধ ও প্রবন্ধে এবং বিভিন্ন দলিলপত্রাদিতে বাংলাদেশে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরা কখনো উপজাতি, কখনো আদিবাসী আবার কখনো ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বা ক্ষুদ্র জাতিসত্তা হিসেবে বিবৃত হয়েছে।
ILO-এর সংজ্ঞা অনুযায়ী, আদিবাসী জনগোষ্ঠী বলতে তাদেরই বুঝানো হয়- যে জনগোষ্ঠী কোনো ভূখণ্ডে উপনিবেশ স্থাপন কিংবা অভিবাসনের মাধ্যমে অন্য জনগোষ্ঠীর আগমনের পূর্ব থেকেই সেখানে অবস্থান করছিল। আমেরিকার রেড ইন্ডিয়ান, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার অ্যাব-অরিজিন এবং নিউজিল্যান্ডের মাউরি এক্ষেত্রে প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বাংলাদেশে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলো সে অর্থে এই ভূখণ্ডের আদিবাসী নয়।
১৯৯৭ সালে সম্পাদিত পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে ‘উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানেও ‘আদিবাসী’ পরিভাষাটির উল্লেখ নেই। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ২৩(ক) অনুচ্ছেদে তাদের ‘উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়’ রূপে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এমনকি আমাদের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতের সংবিধানেও আদিবাসী শব্দটির প্রয়োগ দেখা যায় না। সেখানে বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষদের তফসিলি উপজাতিরূপে উল্লেখ করা হয়েছে।
বাংলাদেশের বর্তমান সরকার সাম্প্রতিক সময়ে এসব জাতিসত্তার পরিচিতি ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ রূপে সুস্পষ্ট করেছে।
বাংলাদেশের মূল ও বৃহত্তম নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী বাঙালি জাতি কয়েক হাজার বছর পূর্ব থেকেই এই ভূখণ্ডে বসবাস করে আসছে। এদেশে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীসমূহের অধিকাংশ বিগত পাঁচ/ছয়শ বছরের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে আশপাশের দেশ থেকে এখানে এসেছে। নানান প্রতিকূল পরিস্থিতি ও অন্তর্দ্বন্দ্ব- এর কারণে এ সকল ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর কেউ সংঘাতময় পরিস্থিতির শিকার হয়ে আবার কেউ জীবিকার তাগিদে তাদের আদি নিবাস ত্যাগ করে এই ভূখণ্ডে এসে স্থায়ীভাবে বসতি গড়ে তোলে।
এখন দেশীয় পরিচয়ে এই ভূখণ্ডে বসবাসকারী সকলেই বাংলাদেশের নাগরিক। সকলেই সমান।
ঐতিহাসিক তথ্যপ্রমাণ, আন্তর্জাতিক সংজ্ঞা ও বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী এটা সুস্পষ্ট যে, বাংলাদেশে বসবাসকারী ক্ষুদ্রগোষ্ঠীগুলো কোনো যুক্তিতেই আদিবাসী নয়।
দেশের মোট জনসংখ্যার 99% বাঙালিরাই এই ভূখণ্ডের আদিবাসী।